You are currently viewing ভাঙা-গড়ার লড়াইয়ে মামুন তাহের এর এগিয়ে যাওয়ার গল্প

ভাঙা-গড়ার লড়াইয়ে মামুন তাহের এর এগিয়ে যাওয়ার গল্প

সারসংক্ষেপ:

নারায়ণগঞ্জের সন্তান মামুন তাহের। স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন। কিন্তু বাস্তবতার চাপে সেটা সম্ভব হয়নি। তবে দমেও যাননি তিনি। নানান বাঁধা বিঘ্ন, অনিশ্চয়তা পার করলেন। নিজের মুদি ব্যবসা শুরু করলেন। আজ ঢাকা জেলার ভাটারায় এক সুপরিচিত নাম মামুন তাহের। সৎ, বিনয়ী, সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রমকারী মামুন  সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় সুনাগরিক করে তোলার কাজে নিবেদিত প্রাণ।

মূল গল্প:

ঢাকা শহরের বসুন্ধরা সংলগ্ন ভাটারা এলাকা। ভোরের আকাশে আজানের ধ্বনি মিশে যেতেই কোলাহল করে ডেকে ওঠে পাখিরা। সেই পাখি ডাকা ভোরে, শহরের বেশিরভাগ মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকেন, ঘুম ভেঙে যায় মামুন তাহেরের। ভোরেই দোকানে চলে যান মামুন। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য দিয়ে সাজানো তাঁর দোকান। দিনের শুরুটায় কাস্টমারের চাহিদা অনুযায়ী যোগান দেন সব পণ্যের। সঠিক দাম আর মানে ভালো হওয়ায় মামুনের দোকানেই কাস্টমারেরা ভিড় জমান। মামুন এসব দেখে তৃপ্তির হাসি হাসেন। তবে এই হাসির পেছনে আছে নানান চড়াই-উৎরাই জয় করার গল্প।

নারায়ণগঞ্জের ছেলে মামুন তাহের। বন্দর থানা গ্রামে বেড়ে উঠা। সেখানেই পড়ালেখো করেছেন এস.এস.সি পর্যন্ত। পাঁচ ভাই-বোনদের পরিবারে বাবা, বড় ভাইয়ের আয়ে সংসার চলতো। ছোটবেলা থেকেই দায়িত্বশীল ছিলেন মামুন। ছোট একটা খাবার হোটেল পরিচালনা করতেন তাঁর বাবা। পড়াশোনার পাশাপাশি সেখানে কাজ করতেন।

 
 
 

আলুর চপ, পেঁয়াজু, জিলাপি বেচা-কেনা হতো এ হোটেলে। মামুন এসব খাবার তৈরী করতে ছিলেন পটু । তবে স্বপ্ন ছিলো আরো বড় কিছু হবার।

বাবা ভাইকে বলে ঢাকা এলেন আরো পড়ালেখা করবেন বলে। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হলেন। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুস্তিও নিচ্ছিলেন।  কিন্তু, ভাগ্য যেন তার সহায় ছিলো না। বাবা অকস্মাৎ স্ট্রোক করে চলে গেলেন চিরতরে। ওদিকে গ্রামে ছোট ভাই একা চেষ্টা করছিলো খাবার হোটেলটা চালানোর। তবে কিছুতেই যেন সেই আগের অবস্থায় যেতে পারলেন না তারা। মামুনের বাবার চলে যাবার সাথে সাথে যেন খাবার হোটেলটাও ঝিমিয়ে গেল।

মামুনের বড় ভাই বেশ দুচিন্তায় পড়ে গেলেন। এতো বড় সংসার, উপার্জন বলতে তাঁর সামান্য আয় আর এই খাবার হোটেল। সে-ও আগের মতো চলছে না। সংসারে অনটনের আভাস। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তাঁরা । মামুনকে ডেকে পাঠালেন ঢাকা থেকে। ওদিকে অতি আদরের ছোট ভাইটাও সবে মাত্র হাইস্কুলের গন্ডিতে পা দিয়েছে। তাকে হোটেলের কাজ করতে দিলে পড়াশোনায় বেশ ক্ষতি হয়ে যায়। দিশেহারা বড় ভাই কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না, তখন মামুন বললেন সংসারের হাল তিনিও ধরতে চান। বড় ভাই-ও ভেবে দেখলেন, এছাড়া উপায় নেই। পরামর্শ দিলেন, কোন একটা দোকানে কাজ করতে।

ভাইয়ের কথা মতোই ২০০৯ সালে চলে এলেন ঢাকার ভাটারা এলাকায়। এখানেই একটি ছোট মুদি দোকানে কাজ শুরু করেন। মামুনের সততা আর সুন্দর ব্যবহারের ফলে বেশ কিছুদিনের মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি সবার মাঝে। তবে বিধাতার এখানেও বোধহয় অন্য কোন পরিকল্পনা ছিল। যে দোকানে মামুন কাজ করছিলেন, সে দোকানটি ভেঙে ফেলা হয়। মালিকও আর নতুন দোকান দিলেন না। ফলে, চাকরিহীন হয়ে পড়েন মামুন। কয়েকদিন খোজাখুঁজির পর আরেকটি মুদি দোকানে চাকরি পেলেন। কিছুদিন এ দোকানে ভালোই চললো তার দিনকাল। এখানে কাজ করতে গিয়েই পরিচিত হলেন, ডিজিটাল হিসাব রাখার অ্যাপ টালিখাতা-এর সাথে। ভালোই যাচ্ছিল মামুনের দিন। তবে সেই ভালোও আসলে স্থায়ী হলো না। আবার দোকান ভেঙে দেয়া হলো। আবারো চাকরিহীন হলেন মামুন।

তবে আশাহত হলেন না। যে ভাটারা এলাকায় তার পরিচিতি গড়ে উঠেছে, ভাবলেন সেখানেই ছোট্ট একটুখানি পুঁজি নিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করে দিবেন। যেই ভাবনা সেইখান থেকেই নিজের জন্য একটি দোকান ভাড়া নিলেন। মামুনের মনে হলো, ভেসে যাওয়া মানুষ যেন এবার একটু দাঁড়াবার আশ্রয় পেলেন। অল্প-স্বল্প পণ্য দিয়ে নিজের দোকানটা গোছালেন তিনি। এলাকাতেও পরিচিত হওয়ায় মামুনের দোকানে কাস্টমারের দেখাও মিললো ভালো। তবে, একা মানুষ হওয়ায়, কখনোই সঠিক হিসাব পেত না। বাকি ভুলে যেত। লাভ-লোকসান বুঝা যেত না।

মামুন ভাবলেন, কী করলে এ সমস্যা মিটবে। বড় বড় চেইন শপ সুপার শপে ব্যবসায়ের সফটওয়্যার দেখে ভাবতেন যদি সে এরকম ডিজিটাল মাধ্যমে হিসাব রাখতে পারত! একদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোরাফেরা করছিলেন, তখন দেখতে পেলেন টালিখাতা অ্যাপটি। মনে পড়লো এ অ্যাপতো তিনি ব্যবহারও করেছিলেন আগে। কয়েক বছর আগেই অন্যের দোকানের হিসাব রাখতে ব্যবহার করতেন তিনি। ভাবলেন, তাহলে নিজের দোকানের জন্য নয় কেন! 

এবার যেন আর বিধাতা নারাজ হলেন না মামুনের উপরে। টালিখাতা অ্যাপের মাধ্যমে বাকির হিসাব রাখা শুরু করলেন তিনি। শুধু তাই নয়, দৈনন্দিন কেনা-বেচার হিসাবও রাখেন এখানে। হিসাবের যে ভুলগুলোর জন্য শুরুতে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছিল, সেটা যেন টালিখাতা অ্যাপ আসার পরে নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। শুধু তাই নয়, টালিখাতা অ্যাপে নিজের পারিবারিক মাসের খরচটাও লিখে রাখতে পারছেন মামুন। নিজের দোকান থেকে কোন পণ্য নগদে কিনলে সেটা যেমন লিপিবদ্ধ করছেন, তেমনি বাকিতেও নিজের পরিবারের জন্য কোন পণ্য নিলে সেটাও লিপিবদ্ধ করতে পারেন।

মামুন জানালেন, নিজের নামেই একটা এন্ট্রি হিসাব খুলেছেন তিনি। ফলে, মাসে কতো খরচ করছেন বাজারের পেছনে সেই খবর এখন থাকে হাতের মুঠোয়। যা আগে হিসেব কষেও মেলাতে পারতেন না। ডিজিটাল যুগের সাথে তাল মেলাতে টালিখাতা যেন আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ছোট্ট সে মুদি দোকানটা পরিসরেও বড় করতে পেরেছেন সঠিক আয়-ব্যয়, লেনা-দেনার হিসেব রাখতে পেরে। মামুন ধন্যবাদ দেন টালিখাতা অ্যাপকে।  তাঁর মতে, টালিখাতা অ্যাপ ব্যবহার না করলে হয়তো সঠিক হিসাব রাখতে পারতেন না ও এতো দ্রুত বড় করতে পারতেন না নিজের স্বপ্নে গড়া ‘মামুন জেনারেল স্টোর’-কে।

মামুন তাহেরের স্বপ্ন ছিলো নিজে পড়ালেখা করে বড় হবেন। তা আর পূরণ হয়নি। একমাত্র মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন, স্বাবলম্বী করবেন, এটাই তাঁর স্বপ্ন এখন। সেই সাথে চান নিজের দোকানটিকে আরো বড় পরিসরে গড়তে।